আমি গত আট বছর যাবত একটা বেসরকারি স্কুলে পড়াচ্ছি। সে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে আমার কিছু মতামত তুলে ধরলাম আপনাদের সামনে। যদি আপনাদের মধ্যে কেউ শিক্ষক হয়ে থাকেন তাহলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই জন্য যে কিছু কিছু কথা অনেকের গায়ে লাগতে পারে, আবার না-ও লাগতে পারে। সারাদেশে গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষকদের হেনস্তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই লেখাটার একটা খসড়া লিখে রেখেছিলাম। কয়েকদিন আগে এর অংশবিশেষ ফেইসবুকে পোস্ট করেছিলাম। এবার কিছুটা এক্সটেন্ড করছি।
"আজকালকার ছেলেমেয়েরা বেয়াদব, মুরব্বী বা শিক্ষকদের সম্মান করে না।" ইদানিং প্রায় সব অভিভাবক ও শিক্ষকগণ এই অভিযোগ করেন। প্রায় বললাম এই জন্য যে, আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, বেয়াদব সর্বকালেই ছিলো, আছে এবং থাকবে। বরং আমার স্কুল জীবনে যেরকম বেয়াদব ও বিপদজনক ছাত্র দেখেছি তাদের তুলনায় এখনকার ছেলেরা দুধভাত বলে মনে হয় আমার। এখন যা হচ্ছে তা আমরা মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কারনে জানতে পারছি। আগে সেটা জানা এতোটা সহজ ছিলো না।
আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যেখানে ছিলাম সেখানে বড়দের সামনে গালি দেয়া যেতো না। যদি ভুলে কখনও গালি বেরিয়ে আসতো তাহলে জিভ কাটতাম। একবার আমার মামা অফিসের গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার এক বন্ধুকে 'মাদার*দ' বলে গালি দেই। তিনি সেটা শুনে এমনভাবে তাকান আমার দিকে যে অন্য ছেলেরাও ভয় পেয়ে যায়। ভাগ্যিস সেদিন কেবল সাবধান করে দিয়েছিলেন। তো, এটা ছিলো অঘোষিত একটা নিয়ম। গালি যে আমরা দিতাম না তা না। কিন্তু বড়দের সামনে না। ঘটনা হলো, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর আমি যেখানে গেলাম সেখানে পরিবারের সদস্যরাও একজন আরেকজনকে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করতো আর সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো তাদের জন্য। প্রথম প্রথম অস্বস্তি লাগলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমিও এক্সপার্ট হয়ে যাই গালাগালিতে। এই যে ট্রান্সফর্মেশন, এটার কারন কেবল পরিবেশ। আর এই পরিবেশ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নরকম। এখন আমরা ফেইসবুক বা ইউটিউবের কারনে বা বিভিন্ন নাটকের ভাষা দেখে বিভিন্ন এলাকার ভাষা বা কালচার রপ্ত করছি। আগে সে সুযোগ ছিলো না। নাটকের ভাষাও তখন মার্জিত ছিলো। এটা ভালো না খারাপ সে তর্কে যেতে চাচ্ছি না।
দেখুন, সমাজ পরিবর্তনশীল। আপনি এখন যাকে বেয়াদব বলছেন সেটা আপনি আপনার সময়কে মাপকাঠি ধরে বলছেন। কিন্তু ২০ বছর আগের সমাজ আর আজকের সমাজ তো এক না। হওয়াটা উচিতও না। পরিবর্তন একটা অবশ্যম্ভাবী প্রসেস। এটা আপনি আটকাতে পারবেন না। পরিবর্তন আসবে বিভিন্নভাবে। আজকাল বিদেশী সিনেমা বা টিভি সিরিজ দেখে দেখে আমারদের মানসিকতা অনেক পাল্টে যাচ্ছে। ওদের লাইফস্টাইল এর একটা প্রভাব আমাদের উপরও আসছে। ফ্রেণ্ডস, ব্রেকিং ব্যাড, সাইনফেল্ড, স্ট্রেঞ্জার থিংস এসব সিরিজের ক্যারেক্টারদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া দেখার পর একজনের চিন্তায় পরিবর্তন আসাটা খুবই স্বাভাবিক। এই যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, এসব আপনি থামাতে পারবেন না। গ্লোবালাইজেশন এর যুগে আমাদের সবার কাছ থেকে শিখতে হবে। শেখার পর যার যা ভালো লাগে সে তা ব্যবহার করবে,যা ভালো লাগবে না তা এড়িয়ে যাবে।
ছাত্রদেরকে বেয়াদব বলার আগে একবার আমাদের উচিত নিজেদের আচরণের দিকে নজর দেয়া। আমরা ছাত্রদের কিভাবে ট্রীট করি সেটা নিয়ে নতুন করে আরেকবার ভাবা উচিত। আমাদের নৈতিকতা বলতে কি কিছু অবশিষ্ট আছে? যে ছাত্র ছোটবেলা থেকে চারপাশে অনৈতিকতার শিক্ষা পেয়ে বড় হচ্ছে সে আপনাকে কিভাবে শ্রদ্ধা করবে? পরিবার, প্রতিবেশি, সহপাঠী, শিক্ষক প্রায় সকলেই এখন অনৈতিকতাকে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ছেড়েছে। শিক্ষক খোলাখুলিভাবেই বলে দিচ্ছেন যে তার কাছে প্রাইভেট না পড়লে ফেইল করতেই হবে। শুধু তাই না, ক্লাসে পড়া না পারলে পিটিয়ে ছাল তুলে নেবেন। টেস্ট পরীক্ষায় ফেইল করলে সাবজেক্ট প্রতি ১০০০ টাকা নেয়ার একটা নিয়ম আছে। যতো ফেইল ততো টাকা। শিক্ষকরা দেদারসে ফেইল করাচ্ছেন। পরীক্ষার খাতার এক্সট্রা পেইজ পর্যন্ত গায়েব করে দেয়ার অভিযোগ পেয়েছি আমি। খাতা দেখার সময় হাতে দুটো কলম নিয়ে বসেন শিক্ষক মহোদয়। একটা কালো কালির, অন্যটা লাল। যারা উনার কাছে প্রাইভেট পড়ে তারা পরীক্ষায় ভুল করলে কালো কালি দিয়ে সেটা সংশোধন করে দেন নিপুন হাতে। আর যারা প্রাইভেট পড়ে না তাদের বেলায় সঠিক হলেও 'সিস্টেম' করে ভুল বানিয়ে দেন।
এই ২০২২ সালে এসেও আমরা ছেলেমেয়েদের পেটানো ছাড়তে পারি নাই। পিটিয়ে পড়া গেলানো এবং সেই পড়া পরীক্ষায় লেখা আকারে উগরে দেয়াকেই আমরা সফলতা মনে করি। ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমরা কটাক্ষ করি। তাদের পছন্দের সাজপোশাক নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করি। আমরা ভাবি, যা করছি তা তো ওদের ভালোর জন্যই করছি। আসলেই কি? না, মোটেও না। আপনি যা ভাবছেন তা যে সবসময় সঠিক হবে ব্যাপারটা এমন না। আপনি আপনার ব্যক্তিগত রুচি অনুসারে আরেকজনকে জাজ করছেন। যতোক্ষণ না তার একটা কাজে অন্য কারও মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে ততোক্ষণ আপনি তাকে খারাপ বলতে পারেন না। কেউ একটু সুন্দর করে সেজে আসলে আপনি তাকে অপমান করতে পারেন না। যদি কোনো সমস্যা থাকে তাহলে তাকে ডেকে সেটা আলাদা করে বুঝিয়ে বললে দ্বিতীয়বার সেই কাজ আর সে করবে বলে আমি মনে করি না। অন্তত আমি তা করেছি।
আমাদের পাঠ্যবইগুলো এমনিতেই যথেষ্ট দুর্বোধ্য। এই দুর্বোধ্য বইগুলোকে সহজভাবে উপস্থাপন করা শিক্ষকদের কাজ। দূর্বোধ্য বই যদি ওরাই বাসা থেকে পড়ে এসে আপনার কাছে 'মুখস্ত' বলে যায় তাহলে আপনি শিক্ষকতা ছেড়ে ঝালমুড়ি বেচেন। মুখস্ত করাটাই একটা অন্যায় কাজ। আর এই অন্যায় কাজ যে যতো ভালো পারে আমরা তাকেই ততো মেধাবী আখ্যা দেই। মুখস্ত করার প্র্যাকটিস বন্ধ করা উচিত অবিলম্বেই।
এবার বলি সবচেয়ে জরুরি কথা। আমরা যারা শিক্ষক, আমাদের পুঁজি হলো ঘিলু বা মগজ। আমরা পাশ করে এসে মনে করি দুনিয়ার তাবৎ জ্ঞান আমাদের হাতের মুঠোয়। ক্লাসে পড়াতে যতটুকু জ্ঞান দরকার ততোটুকু জানলেই আমরা মনে করি যথেষ্ট। না রে ভাই/বোন। এটা খুব ফালতু আর ফাঁকিবাজি ধারণা। আপনাকে অবিরাম নতুন কিছু শিখতে হবে। নিজের বিষয়ের ব্যাপারে তো জানবেনই, এছাড়াও নতুন নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আপনাকে সব সময় খোঁজখবর নিতে হবে। পত্রিকা, বই বা জ্ঞানচর্চার জন্য যা যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করবেন।
এসব বিভিন্ন টপিক নিয়ে আমি আরও বিস্তারিত লিখতে চাই। জানি না এসব লিখে কোনো লাভ হবে কি না। তবুও নিজের মনের আক্ষেপ তো অন্তত কিছুটা হলেও মিটবে।
আমি একদম নতুন লিখছি। যদি কোথাও কোনো খটকা লাগে পড়তে গিয়ে আমাকে জানাবেন,প্লিজ। নিঃসংকোচে সমালোচনা করবেন।
ধন্যবাদ।
আমি মনে করি ছাত্রসমাজের এই অবস্থার কারন সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। আমি আপনার সাথে একমত যে বর্তমান সময়ের মতো আগেও ভালো-খারাপ ছিলো। কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো কখনোই ছিলোনা। তার প্রকৃত উদাহরণ আমার নিজের ক্যাম্পাসেই আছে। এখনকার পোলাপাইন কাউকেই মানতে চায়না 🙂
আপনি ৯৬-২০০০ এর সময়কালটা হয়ত দেখেন নি, ব্রো। দেখলে বুঝতেন কি মারাত্মক একটা সময় গেছে তখন।
Congratulations @spandanlink! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):
<table><tr><td><img src="https://images.hive.blog/60x70/http://hivebuzz.me/@spandanlink/payout.png?202209060638" /><td>You received more than 50 HP as payout for your posts, comments and curation.<br />Your next payout target is 100 HP.<br /><sub>The unit is Hive Power equivalent because post and comment rewards can be split into HP and HBD <p dir="auto"><sub><em>You can view your badges on <a href="https://hivebuzz.me/@spandanlink" target="_blank" rel="noreferrer noopener" title="This link will take you away from hive.blog" class="external_link">your board and compare yourself to others in the <a href="https://hivebuzz.me/ranking" target="_blank" rel="noreferrer noopener" title="This link will take you away from hive.blog" class="external_link">Ranking<br /> <sub><em>If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word <code>STOP <p dir="auto"><strong><span>Check out the last post from <a href="/@hivebuzz">@hivebuzz: <table><tr><td><a href="/hive-122221/@hivebuzz/pum-202208-delegations"><img src="https://images.hive.blog/64x128/https://i.imgur.com/fg8QnBc.png" /><td><a href="/hive-122221/@hivebuzz/pum-202208-delegations">Our Hive Power Delegations to the August PUM Winners <tr><td><a href="/hive-122221/@hivebuzz/pud-202209-feedback"><img src="https://images.hive.blog/64x128/https://i.imgur.com/zHjYI1k.jpg" /><td><a href="/hive-122221/@hivebuzz/pud-202209-feedback">Feedback from the September 1st Hive Power Up Day<tr><td><a href="/hive-122221/@hivebuzz/pum-202208-result"><img src="https://images.hive.blog/64x128/https://i.imgur.com/mzwqdSL.png" /><td><a href="/hive-122221/@hivebuzz/pum-202208-result">Hive Power Up Month Challenge 2022-08 - Winners List <h6>Support the HiveBuzz project. <a href="https://hivesigner.com/sign/update_proposal_votes?proposal_ids=%5B%22199%22%5D&approve=true" target="_blank" rel="noreferrer noopener" title="This link will take you away from hive.blog" class="external_link">Vote for <a href="https://peakd.com/me/proposals/199" target="_blank" rel="noreferrer noopener" title="This link will take you away from hive.blog" class="external_link">our proposal!